যোগ সংক্রান্ত তত্ত্ববিদ্যা

যােগ এর সংজ্ঞা :  ‘ যােগ ’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত ' যুজ ' ধাতু থেকে , যার অর্থ কোনও দু'টি জিনিষকে যুক্ত করা বা একত্র করা । প্রাচীন মুনি ঋষিদের মতে জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনই হল যোগ। মহর্ষি পতঞ্জলি ‘ যােগ ’ - এর সংজ্ঞা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন , চিত্তের বৃত্তি  সকলকে নিরােধ করার নামই যােগ — 'যােগশ্চিত্তবৃত্তিনিরােধঃ' ; যােগ হল সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আমাদের চিন্তা - ভাবনা , বিচার , অনুভ , কল্পনা প্রভৃতি মানসিক বৃত্তি বা কার্যাবলীর উপর নিয়ন্ত্রণ আনা সম্ভব । অন্যভাবে বলা যায় , চিন্তাধারা ও কাজকর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে দেহ - মনকে এক সুরে বেঁধে জীবনকে সুন্দরভাবে গড়ে তােলাই যােগ । 


যােগের প্রকারভেদ : প্রাচীন শাস্ত্ৰ শিৰ - সংহিতায় যােগকে প্রধানতঃ চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে — মন্ত্রযােগ , হঠযােগ , লয়যােগ , রাজযােগ । 

মন্ত্রযােগ — একটি নির্দিষ্ট নিয়মে আরাধ্য দেবতার নাম বা মন্ত্র জপ করতে করতে নামের সাথে একাত্ম হয়ে যাওয়াই মন্ত্রযােগ । এই মন্ত্রশক্তির সাহায্যে সূক্ষ অধ্যাত্ম চেতনার বিকাশ হয়ে থাকে ।

মন্ত্র জপ তিন ভাবে করা যেতে পারে-

 ( ক ) বাচিক — উচ্চস্বরে , যেন সবাই শুনতে পায় ।

 ( খ ) উপাংশু — শুধুমাত্র ঠোট নড়বে , শব্দ শােনা যাবে না ।

 ( গ ) মানস জপ — নিঃশব্দে জপ করার সাথে সাথে মন্ত্রের অর্থ স্মরণ করা হয় । এই জপই শ্রেষ্ঠ ।

 মন্ত্র জপের মাধ্যমে সহজেই মনের একাগ্রতা আনা যায় । 

হঠয়ােগ — ‘ হঠ শব্দটি ' হ ' এবং ' ঠ 'এই দুই অক্ষরের সমষ্টি । ' হ ’ এর অর্থ সূর্য , 'ঠ 'অর্থে চন্দ্র ; দেহস্থ সূর্য ও চন্দ্র নাড়ীর মিলনই হঠযােগ । মানুষকে সুস্থ ও দীর্ঘজীবি করাই হঠযােগের উদ্দেশ্য । এই যােগের যাবতীয় ক্রিয়া শরীরের সাথে সম্বন্ধ যুক্ত । নানারূপ কঠিন ও জটিল হঠযৌগিক প্ৰণালী অভ্যাসকারীকে বলা হয় হঠযােগী । 

লয়যােগ - দেহস্থ কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগ্রত করাই লয়যােগের উদ্দেশ্য । দেহের একটি নির্দিষ্ট স্থানে মনােনিবেশ করে মনের পৃথক সত্তাকে লয় করা বা বিলীন করাকেই বলা হয় লয় যােগ । এই অবস্থায় নিজ দেহের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন পৃথক চেতনা থাকে না , মন চলে যায় সাধনার অনেক উচ্চ স্তরে । 

রাজযােগ — হঠযােগের পরবর্তী স্তর রাজযােগ — মূলতঃ মনকেন্দ্রীক । মনের বিভিন্ন প্রকার অশুভ প্রবৃত্তিকে জয় করে একাগ্রতা বৃদ্ধির মাধ্যমে গভীর দিব্য অনুভূতি অর্জন করাই রাজযােগ । এই যােগে মন অন্তর্মুখী হয় এবং নিজের মানসিক অবস্থান বুঝতে সাহায্য করে । রাজযােগের সফলতার জন্য দীর্ঘ সাধনার প্রয়ােজন হয় ।

 শিৰ সংহিতা বর্ণিত উপরােক্ত চার প্রকার যােগ ছাড়া আরও কয়েক প্রকার যােগের প্রচলন দেখা যায়।

জ্ঞানযোগ — ভারতীয় যােগীদের মতে সুখ নয় , জ্ঞানই চরম লক্ষ্য । একমাত্র জ্ঞানার্জনের দ্বারাই মুক্তিলাভ বা মােক্ষলাভ সম্ভব । সুখ একসময় শেষ হয়ে যায় , অতি - সুখ শেষ পর্যন্ত দুঃখের কারণ হয় । জ্ঞান , অন্তর্নিহিত শক্তিকে জাগাতে ও আত্মোপলব্ধি আনতে সাহায্য করে । অতএব জ্ঞানই শক্তি । এখানে জ্ঞান বলতে আত্মজ্ঞান ৰা দিবজ্ঞানকে বােঝান হয়েছে । 

কর্মযােগ — কোন রকম ফলের আশা না করে নিঃস্বার্থ ও সৎভাবে কাজ করে যাওয়াই কর্মযােগ । কর্মযােগীর কাছে কোন কাজ ছােট নয় । তাঁর কাছে সব কাজই আনন্দে পূর্ণ ; মানব জাতির সেবার মাধ্যমেই তিনি অনুভব করেন ঈশ্বরের সান্নিধ্য । কোন দিকে ক্ষেপ না করে তিনি নিজের কাজে মগ্ন থাকেন , এবং সদা সতর্ক থাকেন যেন তার কাজের দ্বারা কারও কোন অসুবিধা বা ক্ষতি না হয় । কার্যের মাধ্যমেই তিনি সিদ্ধি বা সাফল্য লাভ করেন । কর্মযােগে আত্ম অহংকার , দাম্ভিকতা ও স্বার্থপরতার কোন স্থান নেই ।

ভক্তিযােগ — কর্মযােগ পালনের মাধ্যমেই ভক্তিযােগের প্রতি অনেকটা  এগিয়ে যাওয়া যায় । কর্মের প্রতি এবং আরাধ্য দেবতার প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা ও ভক্তিই হল ভক্তিযােগের মূলকথা । অন্যান্য যােগের ক্ষেত্রে কিছু জ্ঞান অর্জন বা শিক্ষার প্রয়ােজন থাকে ; কিন্তু ভক্তিযােগের ক্ষেত্রে সেরকম কোন প্রয়ােজন । নেই । নিজেকে সমর্পণের মাধ্যমেই ভক্ত আনন্দ লাভ করে থাকেন এবং এই অনিন্দই তার চরম প্রাপ্তি । তাই , ভক্তিযােগ ধনী - দরিদ্র , শিক্ষিত - অশিক্ষিত সকলের পক্ষেই উপযােগী । 

ক্রিয়াযােগ — পাতঞ্জল যােগ দর্শনে বলা হয়েছে তপঃ স্বাধ্যায়েশ্বর প্রণিধানানি ক্রিয়াযােগঃ , অর্থাৎ নিয়মিতভাবে তপস্যা করা , শাস্ত্র পাঠ করা ও শাস্ত্র কথা শােনা এবং পূজা - অর্চনা করাই ক্রিয়াযােগ । ক্রিয়া ও কর্ম — শব্দ দু'টি প্রায় একই রকম শােনালেও কর্মযােগী তার কাজের মাধ্যমে অন্যদের সাথে যুক্ত থাকেন , কিন্তু ক্রিয়াযােগীর চিন্তা - ভাবনা নিজের মানসিক স্তরেই সীমাবদ্ধ । থাকে । ক্রিয়াযােগের সাহায্যে মনকে নিজের বশে আনা যায় । “ ক্রিয়াযােগ । শব্দের আক্ষরিক অর্থ কর্মের ( ঈশ্বর উপাসনা ) দ্বারা যােগের পথে অগ্রসর হওয়া । 

বিভিন্ন প্রকার যােগের মধ্যে পদ্ধতিগত পার্থক্য খুবই কম - অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটির সাথে আরেকটির সামঞ্জস্যই বেশী । মুনি - ঋষিগণ তাদের সাধনার ক্ষেত্র অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন নাম দিয়েছেন । এই বিভাগ খুব সুনির্দিষ্ট নয় । যােগের একটি বিশেষ পথে সাধনায় অগ্রসর হলেও অন্যান্য যােগের প্রভাব তার ওপর সব সময়েই থাকে ।

Comments

Popular Posts